আমি আমার লেখালেখির জীবনে সম্ভবত লক্ষ-লক্ষ শব্দ লিখেছি কিন্তু আজকের পূর্বে ধর্ষণ শব্দটা পারতপক্ষে লিখতে চাইনি। লিখতে ইচ্ছা হয়নি। লিখেছি হয়তো এভাবে চরম শারীরিক নির্যাতন বা অন্য কোন প্রকার শব্দ-বাক্য। আমি সব সময় আমার পাঠককে আমার চেয়ে বুদ্ধিমান মনে করে এসেছি। তাই ধর্ষণ লিখে বা পাতার-পর-পাতা ধর্ষণের বর্ণনা দিয়ে এঁদের বুদ্ধিকে খাটো করার কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি।
বাহে, এক চোখে তেল এক চোখে ঘি দিলে হবে না তো! আদতে আমরা শিক্ষাটা কী দিচ্ছি? বাংলা-হিন্দি সিনেমায় কোন নায়ক যখন কোন নায়িকাকে মারাত্মক রকম উত্যক্ত করছে, উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন আমরা ভারী আনন্দিত। পশ্চাদদেশ নাড়িয়ে আমাদের করতালিতে হলের ছাদ উড়ে যায়-যায় অবস্থা। আবার বাস্তবে যখন এই কাজটা করে কোন ছোকরা নায়ক হওয়ার চেষ্টায়, তখন আপনি-আমি গরম কড়াইয়ে পানি ফেলার মত ছ্যাৎ করে উঠছি। কেন রে, বাপু! একি অনাচার!
আজ একটা জাতীয় দৈনিকে চোখ বুলিয়ে আমি হতভম্ব! গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত জায়গা দখল করে রেখেছে ধর্ষণের খবর। হঠাৎ করেই কী ধর্ষণ মহামারির আকার ধারণ করল? এখানে আমার খানিকটা অমত আছে। এই অনাচারটা ছিল, আছে। মিডিয়ায় তেমন আসেনি। আমার মনে আছে খোদেজা [১] নামের একটা ছোট্ট বাচ্চার নিউজটা এসেছিল মফঃস্বলের সিঙ্গেল কলামে, চোখে পড়ে না এমন করে।
কিন্তু এখন মিডিয়ার কাছে ধর্ষণের সংবাদ খুবই আগ্রহের, পরম পূজনীয়। পাবলিক খাচ্ছে। আর পাবলিক যা খায় মিডিয়া তাই খাওয়ায়। পূর্বে একজন ধর্ষিতার পরিবার থানার সামনে ঘেঁষতেই পারতেন না। আর পারলেও দেখতে পেতেন ধর্ষক মহোদয় ওসি সাহেবের সঙ্গে আয়েশ করে বসে চা পান করছেন। এখন যেহেতু মিডিয়া জেগেছে তাই ওসি সাহেবরা আর আগের মত চা-পানে আরাম পাচ্ছেন না। আবার এ-ও সত্য এখন হয়তো অনেকে সাহস করে এগিয়ে আসছেন।
আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ না তবুও নোয়াখালির ওই ভিডিওটা দেখার সাহস করতে পারিনি কিন্তু এর বিভৎসতার থাবার দাগ আমাদের মুখে খানিকটা থাকা প্রয়োজন। এখানে আমি একটা স্ক্রিণশট ব্যবহার করব। আমিনুল ইসলাম নামে একজন ভদ্রলোকের লেখার স্ক্রিণশট। তাঁরটাই কেন এর ব্যাখ্যা পরে দিচ্ছি। ইনি দীর্ঘ অনেকটা বছর ধরে বিদেশে বসবাস করেন এবং বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আমি যতটুকু দেখেছি অসম্ভব মার্জিত একজন মানুষ। কখনও কটু, কুৎসিত কথা বলতে তাঁকে আমি দেখিনি। কাউকে আহত করে এমন শব্দ তিনি সযতনে পরিহার করেন। এতগুলো কথা বলার কারণ তিনিই নোয়াখালির এই ঘটনার বর্ণনায় শব্দের-পর শব্দ লিখেছেন। কেন লিখেছেন এর ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন:
নোয়াখালির যে ঘটনাটা, ভিডিও-এর কল্যাণে এটার বিভৎসতা সুশীল
সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে এ সত্য কিন্তু আমাদের দেশে শিশু-নারীর সঙ্গে এরচেয়েও নৃশংস ঘটনার অভাব নেই।
কিন্তু আমরা তা জানতে পারিনি তাই আমাদের সুশীলতায় আঁচড় পড়েনি। আমরা আরামেই ছিলাম
এখন একটু ব্যারামে আছি আর কী।
আমরা বরং এমপি মহোদয় মুখ থেকে একটু শুনি:
একজনের শরীর, এটা তার নিজের। তার অমতে, গায়ের জোরে কোন প্রকারেই তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না। হোক সে দেহবিক্রেতা তাতে কিছুই আসে যায় না। নো মানে নো-না মানে না।
পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যেখানে শীতে লোকজন জমে যাচ্ছে পুরুষরা গোটা শরীর ভারী কাপড়ে মুড়িয়ে ফেলছে সেখানে একজন নারী তার ঠ্যাং খুলে রেখেছে। ও সভ্য সমাজ, এর কী ব্যাখ্যা হয় কে জানে!
তবে আমি যে রকমটা বলে আসছি দেশ হচ্ছে মা, রাষ্ট্র পিতা। পিতার শাসন থাকবেই তার সন্তানদের প্রতি। এখন একজন নারী দুম করে এটা বলে বসলেন, শরীর আমার এটা আমি কাকে দেখাব কাকে দেখাব না সে অধিকার আমার। প্রত্যেক রাষ্ট্র-সমাজের নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি থাকে এটাকে আপনি ট্যাবু বললে বলতেও পারেন। ইউরোপের অনেক দেশের ওয়াশরুমের দরোজা নাই তাই বলে এখন আপনি কী এই দেশেও এ নিয়ে হল্লা করবেন? বাপু, এমনটা চাইলে তো হবে না।
যেমন ধরুন, সানাই নামের এই অসভ্য মহিলার কথা।
এ-ও সত্য নির্বোধরা ঘুরেফিরে নারীর পোশাককে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে এই যুক্তি খাটে না। অনেক কারণ এখানে কাজ করে। আদিমানুষ পাহাড়িদের সমাজে ধর্ষণ কী তাদের জানা ছিল না আমরা শিখিয়েছি। যেমনটা আমরা আমাদের ভাষা, আচার-আচরণ, বোলচাল এদেরকে শেখাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
জীব সৃষ্টির পর থেকেই খাবারের মতই শরীরের এই চাহিদা চলে আসছে। যারা এই চাহিদা নামের দানবীয় শক্তিকে খাটো করে দেখেন 'তারা বেকুবের ছা-গুমুতে ভাসে তাদের গা'!
এই গ্রহ নামের চাকা বনবন করে ঘোরাবার জন্য 'এই নর-নারীর সম্পর্ক' নামের দানবীয় শক্তির বিকল্প নেই। আবার এই দানবীয় শক্তির কাছে মানুষ বড় অসহায়। রাশভারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদরেল একজন শিক্ষক কখন কাজের মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়বেন এটা আগাম বলা মুশকিল। এই দানবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তার অস্ত্র পারিবারিক আবহ, শিক্ষা, পারিবারিক অবস্থান, পারিবার-সন্তান, ধর্মীয় মূল্যবোধ। কিন্তু একেক করে তার পায়ের এই সব শেকল ছিড়তে থাকে...।
প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে প্রকৃতি অনিয়ম পছন্দ করে না। কিন্তু ছোট্ট বাচ্চা-একটা শিশুর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করা মানুষগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকৃতির নেই। কেমন করে ওই মানুষটার ডিএনএ-তে এই বিকৃত তথ্য চলে এলো? এটা বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন।
কিছু শিক্ষিত দু-পেয়ে আছে যারা মূল সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা না-করে দুম করে বলে দিল পিটিয়ে মেরে ফেল ব্যাটাকে। এই সব অর্বাচীনদের আবার লাখ-লাখ ফলোয়ার!
ইসলাম বিশ্বাসিদের খুবই স্পর্শকাতর, খুবই শ্রদ্ধার একটা জায়গা মসজিদ-মাদ্রাসা। এখানেও ঘটছে এই সমস্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। হালের একটা ঘটনা উল্লেখ করি এখানে। কিছু শুয়োর আছে যাদের এই বেসিক সেন্সটা নাই যে একটা শিশুর মুখ অন্তত ব্লার করে দিতে হয়। 'র' এই ভিডিওটা ব্লার করতে গিয়ে যেটুকু না-দেখলেই নয় সেই সামান্য অংশটুকু দেখে আমি অসুস্থ বোধ করছি:
কী অন্যায়, কী ভয়ানক এক অন্যায়! আচ্ছা, একটা হিসাব কষে বলুন তো আমাদের দেশের লক্ষ-লক্ষ মসজিদ, মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষকদের মধ্যে কয়জন পরিবার-পরিজন, স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে থাকেন? যুগের-পর-যুগ, বছরের-পর-বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। কেন? এই অসভ্য-অন্যায় নিয়মের পেছনে সমাজের যুক্তি কী! এরা কী রক্ত-মাংসের মানুষ না? নাকি এরা প্রকৃতির সন্তান না- প্রকৃতির নিয়ম, শারীরিক চাহিদা এদের বেলায় খাটে না!
এই দেশ বড় হুজুগে দেশ। এখন আলোচনা হচ্ছে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার জন্য। এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। ছোট্ট যে মেয়েটির বাঁচার যে সামান্যতম সম্ভাবনা ছিল সেটা আর থাকবে না কারণ ধর্ষক জানে ধরা পড়লে মৃত্যুদন্ড তাই ভিক্টিমকে বাঁচতে দেওয়া চলবে না।
আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চিরতরে ঘায়েল করার জন্য এটা হয়ে উঠবে একটা মোক্ষম অস্ত্র। একেবারে প্রাণে শেষ করে দাও!
ভাগ্যিস, বিচারপতি মো.মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের মত কিছু আলোকিত মানুষ থাকেন যারা দু-হাতে অন্ধকার সরিয়ে দেন। নতজানু হই গো!
অন্য অপরাধের মতই ধর্ষণ একটা জঘণ্য অপরাধ কিন্তু প্রায়শই একজনের অপরাধের দায়টা অবলীলায় অন্যরাও মাথায় তুলে নেন। কেন নেন কে জানে! পাশের দেশ ভারতের হাথরাসে সম্প্রতি যে ঘটনা নিয়ে ওদের দেশ উত্তাল... ওই অভাগা মেয়েটির জিভ পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়েছিল।
অপরাধিকে বাঁচাবার জন্য গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র উঠেপড়ে লাগল।
হায় রাষ্ট্র! এই অসহ্য দৃশ্যটা আমার সহ্য হয় না।
No comments:
Post a Comment