বেচারা শরীর! লাইনচ্যুত হল। একটা অস্ত্রাঘাত যার চালু নাম অপারেশনের প্রয়োজন হল। এখন কেউ যদি রসিকতা করেও বলে, 'কী মাঝি, ডরাইছ'? আমি সপাটে বলব, হ, ডরাইছি।
একজন জ্ঞানি মানুষ নাকি মৃতের জন্য শোক করেন না। একজন জ্ঞানি মানুষের কাছে মৃত্যু নাকি কেবল খোলস ত্যাগ করা। হবে হয়তো! আমি জ্ঞানি নই বলেই এ নিয়ম আমার বেলায় খাটে না। তাই আমি আমার মৃত মার জন্য হাহাকার করি, আপাতত জীবিত নিজের জন্য ভয় পাই।
আর মৃত্যু নামের পাজি-নচ্ছার যত দূরেই থাকুক যখন গলা উঁচিয়ে বলে, পাগল, তোকে ছুঁয়ে দেই? তখন ডর লাগে। না-লাগার কোন কারণ আছে? যেমনটা দ্রব্যগুণ! একজন ড্রাগ নেবে আর তার বিভ্রম হবে না তা কী হয়! আউট অভ কোশ্চেন
আমার মনে আছে ২০০৫-৬ সালের কথা। তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্লগস্ফিয়ারে রাতের-পর-রাত জেগে লিখি। আমাদের দেশের একজন বুদ্ধিজীবী যাকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল, খুন করে ছিল-তিনি প্রাণ ভয়ে বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন। আমার এক পাঠক তখন খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, এঁরা আমাদের সেরা সন্তান। বাথরুমের এই বিষয়টা আলোতে না-নিয়ে আসার জন্য। আমি তখন কেবল এই অংশটুকু বাদ দিয়ে লিখলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আমি আমার মত পরিবর্তন করলাম। এ আমি কী করছি! আমি জেনেশুনে সত্য গোপন করছি। মুক্তিযুদ্ধ মানে আলোকে আলো অন্ধকারকে অন্ধকার বলে স্বীকার করে নেওয়া। এখানে ফিকশন মেশাবার বা সত্য গোপন করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে একটা মানুষ ভীত হতেই পারেন অস্বাভাবিক আচরণ করতেই পারেন। সবাই তো কর্ণেল তাহের না বা এটা তো বাংলা সিনেমা না যে রক্তের সাগরে ভাসতে ভাসতে আরোপিত সংলাপের-পর-সংলাপ বলেই যাবেন। মরবেন না। নায়কদের মরার নিয়ম নাই।
যাই হোক, অপারেশনের চেয়ে জরুরি হচ্ছে অপারেশন পরবর্তী জটিলতা। বিশেষ করে আমাদের দেশে এই ফলোআপের দায় খুবই কম। আমার মার বেলায় যেটা হয়েছিল। অপারেশন টেবিলেই ওঁর হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না। কচ্ছপের মত ওটির টেবিল কামড়ে ধরে রইলেন। পরে যখন ক্রমশ ভাল হচ্ছিলেন 'খোকা, আমারে কবে বাড়িত নিয়া যাবি', বলে বকে মরছিলেন তখন সত্যি-সত্যি মরে গেলেন।
ভারী-ভারী কথা থাকুক। আমি আমার স্বজনদের বলে রেখেছি, অপারেশনের পর বাই এনি চান্স ডাক্তার সাহেব ঘড়ি-টড়ি, কলম, চাকু হারিয়ে ফেলেন প্রয়োজনে সবাই যেন চাঁদা তুলে কিনে দেয়। এটার জন্য আবার আমার পেট কাটার দরকার নেই।
আমি এটা বিলক্ষণ জানি এটা আমার প্রথম অপারেশন কিন্তু এটা ডাক্তার সাহেবেরও প্রথম অপারেশন হলে আমার চেয়ে ডাক্তার সাহেবেরই চাপে থাকার কথা।
এমনিতে অপারেশনের পর এই সব লিখলে ভাল ছিল কারণ ডাক্তার সাহেব ক্ষেপে গিয়ে...। একটাই ভরসা। মিলিয়ন-মিলিয়ন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমার মত এই সমস্ত ব্লগ এখন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এখানে পড়ার আর লোক কোথায়, বাওয়া। যে লেখে সেই পড়ে।
তবুও ক্ষীণ আশা, কোন-এক পাঠক কোন-এক কালে যখন লেখা পড়বে তখন এই লেখার পেছনের মানুষটার থাকা, না-থাকাটা খুব জরুরি কিছু না। অমরত্ব তখন কেবল আর গালভরা নাম না...।
*শিরোনামটা মৌলিক হওয়ার কোন কারণ নেই। দাদার, আ মিন জীবনানন্দ দাশের। সোনামাখা হাত দিয়ে এই একটা লাইন লিখে আর না-লিখলেও সমস্যা ছিল না।
No comments:
Post a Comment