চা-বাগানে গেছি ম্যানেজার সাহেবের আমন্ত্রণে। সাহেব কাকে বলে সেদিন দেখলাম। ম্যানেজার সাহেব তার সেলফোনটা খোঁজ করামাত্র বাংলোর কাজের লোক সেলফোনটা নিয়ে এসেছে পিরিচে করে! নত চোখে, বড় তমিজের সঙ্গে। আর বাংলো? বারান্দাটা হচ্ছে ছোটখাটো ফুটবল খেলার মাঠ। আমার সঙ্গে ফৌজি একজন ছিলেন তিনি আবার গলফ খেলার জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মত আনাড়ির শেখার জন্য বারান্দায় খেলতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছিল না। ডাইনিং টেবিলে ত্রিশ-বত্রিশ জন অনায়াসে খেতে পারবেন। তাও আবার দুইটা!
সেই তীর-ধনুক আমার এখানে কেউ বেড়াতে আসলেই ধরিয়ে দিতাম। স্পেনিশ একটা ছেলে এস্ক্রোবনাস [১] তো লাফাচ্ছিল আর আর্চারস-আর্চারস করে হাঁক ছাড়ছিল!
যাই হোক, ওই বাগানে আমার পরে আর যাওয়া হয়নি! যথারীতি আমার মত চুতিয়ার এদের নিয়ে আর লেখাও হয়নি! তো, দু-পাতাপড়া আমি, এদের জন্য লিখিনি এই পাপ খানিকটা মোচন হলো। বই পড়ে! আমি যে কাজটা করতে পারিনি সেই কাজটা অন্য-একজন করে দেখিয়েছেন। হালে, চা-বাগানের ভূতপূর্ব ম্যানেজার মোরশেদ আলম হীরা'র (https://www.facebook.com/atm.m.alam) অসাধারণ একটা বই পড়ার সুযোগ হল, 'চা বাগানের বিচিত্র জীবন'। অসাধারণ শব্দটায় অতিশয়োক্তি নেই কারণ এই মানুষটা খুব কাছ থেকে দেখে লিখেছেন। এই বইটায় কী নেই! আনন্দ-বেদনা-রসিকতা-উইট। একজন পাঠক হিসাবে আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। বইটার কিছু-কিছু অংশ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করছেন:
"(ব্রিটিশ) মি. মোরশেদ, ডু ইউ হ্যাভ এনি গার্লফ্রেন্ড?
(লেখক) ইয়েস, মাই মাদার ইজ মাই গার্লফ্রেন্ডস, শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড
(ব্রিটিশ): আর কেউ আছে?
মাই সিসটার্স আর মাই গার্লফ্রেন্ডস, দে আর মাই গুড ফ্রেন্ডস।
(ব্রিটিশ): আর কেউ? তুমি জানো আমি কি বলতে চাইছি।
(লেখক): হেসে বললাম, বুজেছি তুমি কী বলতে চাও। এখনো এমন কেউ নেই।"
লেখকের বসকে নিয়ে চমৎকার এক বর্ণনা:
"উনি (কয়েস চৌধুরী) গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, Why did you call me sir?
উনার পাল্টা প্রশ্নে অপ্রস্ত্তত হয়ে গেলাম এই ভেবে যে স্যার বলে আমি (লেখক) আবার কি ভুল করলাম। বললাম, You are my boss and that's why i called you sir.
উনি বললেন, When you see me in the field call me sir, but here in the club you can call me bastard Koyes."
দুই বিদেশিনী এসেছে বেড়াতে:
"(মার্কিন ললনা)...হেসে বলল, তুমি কি আমাদের ভয় পাচ্ছো?
(লেখক) ভয় তো কিছুটা পাবই কারণ তোমরা দুজন আর আমি একা।
আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা দুজন কিন্তু সমকামী।"
মুন্ডাদের কথা এসেছে এখানে। এঁরা, মুন্ডারা রক্তচোষা জোঁক নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাথা ঘামাবার সময় কোথায় তাছাড়া এঁদের কথা যেন এ আরেক জীবনদর্শন:
"জোঁকরা তো আমার বাড়ি আসেনি, আমি ওদের বাড়ি গিয়ে বিরক্ত করেছি। আর রক্তই তো জোঁকের খাদ্য, খেয়ে বাঁচুক না ওরা। আমি তো এইটুকুন রক্তের জন্য মরে যাবো না।"
চা-বাগানের শ্রমিকদের খাওয়ার হাহাকার উঠে এসেছে খানিকটা:
"...আমাকে খেতে অনুরোধ করলে আধা ইঞ্চি পুরু একটা রুটি থেকে সামান্য একটু ছিঁড়ে ওদের লবণ চা'তে ডুবিয়ে খেলাম। বাংলোয় ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত ভেবেছি দিনের পর দিন এই বিস্বাদ জিনিস খেয়ে ওরা বেঁচে আছে কীভাবে।"
অন্যত্র লেখক লিখছেন:
"বাগানের বাইরের জগত তাদের একেবারেই অচেনা। ...এরা জন্মেছে এখানে মরবেও এখানে। চা বাগানই তাদের জীবন, চা বাগানই তাদের মরণ, চা বাগানই তাদের নিয়তি। বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ গরিব, এই গরিবদের মধ্যে সবচেয়ে গরিব হলো বিভিন্ন উপজাতির এই চা শ্রমিকরা। ইংরাজিতে বলা যায়, These people are the poorest of the poor.
কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, গরিবের মধ্যে সে গরিব, ছোটোলোকের মধ্যে আরও বেশি ছোটোলোক।"
এই রকম অজস্র কোট আমি করতে পারি কিন্তু এটা সমীচীন হবে না। এই বইয়ের প্রকাশক, স্বরে অ-এর প্রকাশক রে-রে করে তেড়ে আসবেন।
যাই হোক, এখন চা শ্রমিকদের আন্দোলনে দেশ উত্তাল। ১২০ টাকা নাকি এখনও মজুরি। ভাবা যায়, যতই রেশনের কথা বলা হোক আর ফ্রি বাসস্থান এই সমস্ত ভংচং কথা অর্থহীন! এখন এঁদের চাওয়া খুব বেশি না। মাত্র ৩০০ টাকা মজুরি!
এই দেশের চা-বাগান থেকে উৎপন্ন চা ১৬ কোটি টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় আবার টেস্ট করে আমোদিতও হন। এহেন চা পানে বেহেশতি আমোদ আসে কি না কে জানে!
এই দুইটা ভিডিও ক্লিপ এখানে থাকাটা খুব জরুরি:
মালিকপক্ষরা যা বলছেন তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন এই ভদ্রলোক:
সহায়ক সূত্র:
১. (এস্ক্রোবনাস) পায়ের নীচে সর্ষে: https://www.ali-mahmed.com/2018/05/blog-post_8.html
No comments:
Post a Comment