লেখক: আনসারি তৌফিক
" রকমারি’র প্রতিষ্ঠাতা, বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী, এসএসসি ও এইচএসসি-তে ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছাত্র, মাহমুদুল হাসান সোহাগ সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি দীর্ঘদিন নাস্তিক ছিলেন। তারপর নাস্তিক থেকে এখন আস্তিক হয়েছেন। ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে খুবই চমৎকার ব্যাপার এটি। কে আস্তিক হবে, নাস্তিক হবে, সেটি তার তার ব্যক্তি বিবেচনা।
কিন্তু তার দীর্ঘ দুই ঘন্টার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারিত ভিডিওটিতে (মূল সাক্ষাৎকার চার ঘন্টা) দেখা যায়, তার সামগ্রিক বক্তব্য খুবই প্রবলভাবে বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা পূর্ণ। সেসবের উপর দাঁড়িয়ে তিনি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ও ইঙ্গিত দিয়েছেন যা বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্নমত পোষণকারীদেরকে সামাজিকভাবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে প্রভাবিত করবে। তাই এ ব্যাপারে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি।বিশেষ করে, তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞান, গণিত ও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যেনতেনভাবে নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি দেখালেন এবং তার পরিবর্তনের প্রধান তিনটি পয়েন্ট হিসেবে তিনি মিসরের পিরামিড, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে যেভাবে খুবই সরলীকরণ করে ব্যাখ্যা করেছেন, এই তিনটি পয়েন্ট থেকে তার ধর্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার ‘সূত্র’ এবং যে ঘটনাক্রম তিনি উল্লেখ করেছেন, তাতে বাংলাদেশের তরুণদের কাছে কেবল ভুল বার্তাই যেতে পারে। কারণ, তারা ইতিহাস, বিজ্ঞান ও অর্থনীতির বস্তুনিষ্ট অধ্যয়নের চেয়ে ব্যক্তি মাহমুদুল হাসান সোহাগ-এর একাডেমিক সফল ক্যারিয়ারের গ্ল্যামার দ্বারা 'বায়াস' হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই আমি কয়েকটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো। লেখাটি দীর্ঘ হতে যাচ্ছে। খুব বেশি আগ্রহী না হলে এড়িয়ে যেতে পারেন।
১. কমপ্লেক্স নাম্বারকে তিনি এর স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরিয়ে রহস্যময় করে উপস্থাপন করেছেন। এতে দর্শকের মনে হয়েছে পৃথিবীতে কমপ্লেক্স নাম্বার থাকা মানেই বিরাট ‘অলৌকিক’ কোনো ব্যাপার! আদলে তার কিছুই নয়! মানবজাতি তার হিসাবের সুবিধার্তে ঘটনাক্রমে দশমিক সংখ্যায় অভ্যস্ত। তার মানে তো এই না যে, এটিই স্বাভাবিক। এর মাধ্যমে তো সবকিছু হিসেব করা যায় না। আরো অসংখ্য ধরণের সংখ্যা আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে জটিল সংখ্যা, বা কমপ্লেক্স নাম্বার। কিন্তু আসলে এটিও তো একটা স্বাভাবিক সংখ্যাই, অন্তত গণিতের দৃষ্টিতে। কেবলমাত্র মানুষের গণনার দৃষ্টিকোণ থেকে একটু কঠিন বিধায় একে নাম দেওয়া হয়েছে জটিল সংখ্যা বা কমপ্লেক্স নাম্বার। সাধারণ দর্শকের সামনে রুট, স্কয়ার, কিউবের আলোচনা করে কমপ্লেক্স নাম্বারকে অতিরঞ্জিত রহস্যপূর্ণ করে তোলা নিছক বাড়াবাড়ি ছিল। এর সাথে অলৌকিকতার ইঙ্গিত তো আরো ভয়াবহ!
২. এক পর্যায়ে ‘মিরাকল কোরআন’ নামক একটি বই তার কাছে আসে। এতে তিনি ‘কোরআনের ১৯ থিওরি’-সহ বেশ কিছু মিরাকলের সাথে পরিচিত হন। এই ব্যাপারগুলো তাকে ধীরে-ধীরে প্রভাবিত করে বলে তিনি দাবি করেছেন। এক্ষেত্রে শুরুতেই যে ভুলের সাথে তিনি তার চিন্তার উদ্যোগে পরিবর্তন করেছেন, সেটি হচ্ছে, কোরানে সংখ্যাগত যে মিরাকলের দাবি সর্বপ্রথম যিনি করেছিলেন, মিসরীয় মার্কিন লেখক রাশাদ খলিফা, তিনি তার গবেষণায় কোরানের আয়াত সংখ্যা দাবি করেছিলেন ৬৩৪৬ টি। (যা মুসলিম বিশ্বে স্বীকৃত নয়)। এই আয়াতসংখ্যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য (১৯×৩৩৪=৬৩৪৬)! এখানে, রাশাদ খলিফা নিজের হিসাব মিলানোর জন্য চতুরতার সাথে এমন একটা আয়াতসংখ্যা নির্বাচন করলেন, যেখানে অনেকগুলো বিষয়কে তিনি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হিসেবে দেখানো যায়। এর সেজন্য তাকে অনেক আয়াত বাদ দিতে হয়েছে! তার সেই সুচতুর দাবিসমূহের ভিত্তিতেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘মিরাকল কোরআন’ কনসেপ্টটি জনপ্রিয় হয়। আমাদের আলোচ্য- মাহমুদুল হাসান সোহাগ তারই শিকার বলা যায়। অথচ, তিনি চাইলেই বিষয়গুলো যাচাই করে নিতে পারতেন।
[এখনো সে সুযোগ আছে!]
৩. এরপর তিনি একটি ডকুমেন্টারির প্রসঙ্গ বলেছেন। যেখান থেকে তিনটি পয়েন্ট নিয়ে চিন্তিত হন। সেই তিনটি পয়েন্ট তাকে সংশয়বাদী থেকে ধার্মিক হবার পথে ধাবিত করলো। সেই তিনটি ব্যাপার আমি এখানে উল্লেখ করছি।
প্রথমত: মিসরের পিরামিডের প্রযুক্তি তাকে অবাক করেছে। এর সাথে তিনি লিংক করেছেন কোরানে ফেরাউন ও মুসা নবীর প্রসঙ্গ অনেকবার আসার বিষয়টি। এটিকে তিনি ‘রহস্যময়’ করে তুলেছেন এবং এর পেছনে খোদার ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাপার হিসেবে চিন্তা করেছেন। এখানে তিনি যে প্রশ্নটির কথা বলেছেন, এত-এত নবী থাকতে, কোরানে ফেরাউন আর মুসা নবীই কেন বারবার আসলো? এটিকে তিনি অলৌকিক ইঙ্গিতের দিকে নিয়ে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে সত্যটা হলো, মিসরীয় সভ্যতা ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি চর্চিত বিষয়। সেকালের আরবেও এ নিয়ে চর্চা ও কৌতুহল ছিল। মুসা নবীর অনুসারী হিসেবে ইহুদিরা সবকালেই যথেষ্ট রকম আলোচ্য বিষয়। তখনকার আরবেও যেকোন নতুন ব্যাপার নিয়ে কথা উঠলে, প্রায় সবকিছুকেই ইহুদিদের প্রশ্ন ও চিন্তা পার হয়ে উতরাতে হতো। স্বভাবতই কোরানেও তাদের অনেক অনেক প্রশ্ন এসেছে, প্রসঙ্গ এসেছে। সেই সূত্রে ফেরাউন ও মুসা নবীও এসেছেন সর্বাধিক পরিমাণে। এটি খুবই স্বাভাবিক। এটাকে অতিরঞ্জিত করে অন্য দিকে মুভ করা চতুরতা ছাড়া কিছুই না। কিন্তু এটিকেই সংশয়বাদী থেকে ধার্মিক হয়ে উঠার মতো যথেষ্ট ‘পয়েন্ট’ হিসেবে নিলে কিছুই বলার থাকে না।
দ্বিতীয়ত: তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার উত্থান, এবং সেটি বৃটিশদের বিনাদ্বিধায় মেনে নেওয়াটাকে তিনি অস্বাভাবিক হিসেবে দেখেছেন। তার কাছে এটি অবাক লেগেছে যে, একজন পরাশক্তি কেন অপর একটি নতুন পরাশক্তিকে সহজেই মেনে নিবে? এমনকি যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় এবং বৃটেনের জয়ের পরও তারা কেন উপনিবেশগুলো ছেড়ে দিলো? এগুলোকে তিনি খুবই রহস্যপূর্ণ মনে করেছেন, এবং বিশ্ব রাজনীতির এই বিষয়টি তাকে ধর্মের অলৌকিকতার দিকে মুভ করতে স্পার্ক করেছে! অথচ, সত্য হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপারগুলো খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, আমেরিকা সে সময় পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র, এবং রাশিয়ার সাথে ইউরোপের দ্বন্দ্ব শুরু হচ্ছিল, সেখানে আমেরিকা ও ইউরোপের মৈত্রী অনিবার্য ছিল। কিন্তু ব্যাপারটিকে ‘ধর্মীয় রহস্যপূর্ণ আচরণের দিকে নিয়ে যাওয়া’ কেবলমাত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যই হতে পারে। কিন্তু এটি একজন সংশয়বাদী ব্যক্তির ধার্মিকতার দিকে মুভ করার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
তৃতীয়ত: বিশ্ব মুদ্রা ব্যবস্থা ও আমেরিকার আধিপত্য নিয়ে চিন্তা তাকে সংশয়বাদীতা থেকে সরে ধার্মিক হতে সাহায্য করেছে! এটিও অবাক করার মতো ব্যাপার।
৪. মাহমুদুল হাসান সোহাগ উপরোক্ত যে তিনটি পয়েন্টকে ফোকাস করেছেন, এবং সেখান থেকে ধার্মিকতার দিকে মুভ করেছেন বলে দাবি করেছেন, সেগুলো খুবই দুর্বল পয়েন্ট। অন্তত, বিশ্ব রাজনীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে খটকা লাগার সাথে ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত হওয়ার দিকে তিনি যে ইঙ্গিত করেছেন, এটি অবাক হওয়ার মতো। তবে তার বক্তব্যমতে বোঝা গিয়েছে যে, ২০১২ সালের দিকে তিনি এই বিষয়গুলো জানতে পেরেছেন! তার মানে, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ইতিহাসের দিকে তিনি যান নি আগে কখনো সেভাবে, অধিকাংশ সময় পার করেছেন প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়ে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। যখনই তিনি অন্যদিকে ফোকাস করেছেন, প্রতিটা বিষয় তাকে অবাক করেছে (আগে না জানার অজ্ঞতা থেকে), এবং স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলো তার কাছে রহস্যপূর্ন ঠেকেছে।
৫. কিন্তু এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। আমরা যদি উনার পুরো সাক্ষাৎকারটি শুনি, তাহলে বুঝতে পারবো পুরো ব্যাপারটিই এক ধরণের সাজানো ঘটনা ছিল। কিভাবে? আমি একে একে পয়েন্টগুলো বলছি।
* তিনি বলেছেন, ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কথা বলার চিন্তা তার ছিল না। সচেতনভাবেই তার প্ল্যান ছিল বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা না বলার, বা এড়িয়ে যাওয়ার।
ব্যাপারটি এমন যে, ঘটনাগুলো এতোটাই পিওর আর ন্যাচারাল যে, তিনি না চাইতেও বলা হয়ে গেছে। শ্রোতারা জেনে গেছে। কিন্তু তার এতসব কাহিনী সবাইকে জানানোর কোনো ইচ্ছে ছিল না! অথচ, দেখা যাচ্ছে উপস্থাপক বলছেন, মূল সাক্ষাৎকারটি চার ঘন্টার (৭ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত)। কিন্তু পাবলিশ হয়েছে মাত্র ২ ঘন্টা ৮ মিনিট। যদি প্রকৃতই ধর্মীয় পরিবর্তনের বিষয়টা ফোকাস করার প্রবল ইচ্ছে উনার না-থাকতো, তাহলে তিনি খুব সহজেই সেই অংশগুলো রিমুভ করে পাবলিশ করতে পারতেন। কারণ ভিডিওটি লাইভ ছিল না। রেকর্ডেড ছিল। পরে সম্পাদনা করে পাবলিশ করা হয়েছে। তার মানে সবচেয়ে আকাংখিত (ধর্মীয় সহ) বিষয়গুলোই তিনি পাবলিশ করেছেন। এবং সেটি সচেতনভাবে। কারণ, সাক্ষাৎকারটির প্রথম দিক থেকেই তিনি তার ধর্মীয় অবস্থা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই বলতে শুরু করতে দেখা যায় তাকে। এবং পুরো ভিডিওতে তিনি এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। অর্থাৎ, ভিডিওটির শেষদিকে তিনি যে দাবি করেছেন, (এ বিষয়ে পাবলিকলি কথা বলা তার প্ল্যান ছিল না), এটি মিথ্যা।
৬. তার ধর্মীয় অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি সচেতনভাবে প্রকাশ্যে আনা কি কেবলই মতাদর্শগত বিষয় ছিল, নাকি ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত ছিল? এ প্রশ্নটি আমাকে ভাবায়, যখন উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে তাকে বলতে শুনি যে, তার ব্যবসায়িক গ্রুপের এসেট ভেলু ‘কয়েক হাজার কোটি টাকা!’ এত হাজার-হাজার কোটি টাকা এসেট ভেলুর অধিকারী একজন ব্যক্তি প্রকাশ্যে দুই চার ঘন্টা ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলবেন, তার পেছনের কারণটি নিছক মতাদর্শ ছিল, নাকি ব্যবসা ছিল, চলুন দেখা যাক।
৭. মূল চার ঘন্টার বক্তব্য প্রকাশিত হয়নি। তবে ২ ঘন্টা ৮ মিনিটের যেটুকু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার করা হয়েছে, তার অধিকাংশ সময়ই ছিল তার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প নিয়ে। 'উদ্ভাস' নামে একটি কোচিং সেন্টার এবং 'রকমারি' নামে একটি বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান এর উত্থানের পেছনে তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, সফলতা, ইত্যাদি নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক পার্ট ছিল অনেকটা জুড়ে। এমনকি, উপস্থাপক সুকৌশলে মাহমুদুল হাসান সোহাগ-এর ব্যবসায়িক গ্রুপের অবস্থানটি পর্যন্ত বলে দিয়েছেন। চমৎকার বক্তব্যভঙ্গী, সহজবোধ্যতা ও গতিময়তার সাথে তিনি তার ব্যক্তিজীবনকে ভিত্তি করে মূলত ব্যবসাকেই প্রমোট করেছেন। কারণ, তার কোনো একটি কোম্পানীর কার্যক্রমও তিনি বাদ দেননি, যা তিনি বর্ণনা করেননি! কিন্তু আমরা আরো নিশ্চিত হই, যখন আমরা ফিরে তাকাই কয়েক বছর আগে।
৮. কয়েক বছর আগে, হঠাৎ করে অভিজিৎ রায়ের সমস্ত বই রকমারি তাদের ওয়েবসাইট থেকে উধাও করে ফেলে। অথচ, বাংলাদেশের আইন ও তাদের কোম্পানীর নীতি অনুযায়ী বইগুলা গ্রহণযোগ্য ছিল। মাহমুদুল হাসান সোহাগ নিজেই বলেছেন, রকমারির শুরুর দিকে প্রকাশনীগুলোকে রাজি করাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিন্তু সেই রাজি হওয়া কোনো একটি প্রকাশনীর বই (বা পণ্য) হুট করে কোনো আইনসঙ্গত কারণ ছাড়াই বাতিল করে ফেলাটা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানীর মধ্যে দেখা যায় না! রকমারি তাই করেছিল। এটা কী করে বিজনেস এথিকস হতে পারে? যেখানে বই নিয়েই তার ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে আইনসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই একজন লেখকের বই বাতিল করে দেওয়াটা চূড়ান্ত নীতিহীনতার পরিচয় ছিল। কিন্তু আমাদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছিল। যখন বিবিসি বাংলায় মাহমুদুল হাসানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
[দিনটি ছিল ২০২১ সালের ৩রা নভেম্বর]
৯. অভিজিৎ রায়ের বই সরানো নিয়ে অভিজিৎ এর প্রকাশক দীপন এর সাথে যা কথা হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলার সেই সাক্ষাৎকারটিতে মাহমুদুল হাসান সোহাগ বলেন, ‘তখন আমার উপর একটা অভিযোগ ছিল, আমি নাস্তিক, নাস্তিকদেরকে প্রমোট করি, সো আমাকে হত্যা করতে হবে। সো, দীপন দা (জাগৃতি), উনাকে মেরে ফেলা হলো। শুদ্ধস্বরের টুটুল ভাইক হিট করা হলো। ওই লিস্টে কিন্তু আমি ছিলাম। এবং ওই সময় কিন্তু অভিজিৎ দা’র বই সরায়া দেই। বাট আমার কিন্তু উনার সাথে পারসোনালি রিলেশনশিপ ছিল। বিশেষ করে, জাগৃতির দীপনদার সাথে আমার অসম্ভব ভালো রিলেশনশিপ ছিল। আমি দীপন দা’কে বললাম, দীপনদা আমি বই সরায়া দিছি ভাই। আমার এত সাহস নাই। এক, আমাকে এখানে কতলের ওখানে ইয়ে দিছে, আর দ্বিতীয়ত রকমারিকে হামলা করার জন্যও। রকমারিতে যাকেই পাবে তাকেই হামলা করবে। আমার প্রতিষ্ঠানে লোকজন আমার সন্তানের মতো। আমার অত সাহস নাই যে, আমি ওই বই (অভিজিৎ রায়ের বই) রেখে দিবো।’
১০. এখানে এটা পরিষ্কার যে, ব্যক্তি হসেবে তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান পেশাদারিত্বের সাথেই ব্যবসা করে আসছিল কিন্তু যখন তিনি হুমকির মুখে পড়লেন, আসন্ন বিপর্যয় বুঝতে পারলেন, তিনি অভিজিৎ এর বই সরিয়ে দিলেন। অর্থাৎ, আরো সহজ করে বললে, ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা তাকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, কারণ তিনি অভিজিৎ রায়ের বই তার ওয়েবসাইটে রেখেছিলেন। ফলে, এই তিনি নিজেকে ‘ধর্মবিরোধী নই’ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট রকম উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। এই পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার।
১১. আমরা তার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে জানতে পারি, তিনি সংশয়বাদী থেকে ধার্মিকতার দিকে পা বাড়িয়েছেন ২০১২ সালের দিকে। এবং ২০১২ সালেই তিনি রকমারি শুরু করেছেন। বলা চলে, ধার্মিক মন নিয়েই তিনি 'রকমারি' শুরু করেছেন। সংশয়ী অবস্থান নিয়ে নয়। এবং একজন ধার্মিক মানুষ তার অবস্থানগত কারণেই ধর্মবিরোধী বই মানসিকভাবে অনুমোদন করতে পারেন না। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটি ছিল ব্যবসার প্রশ্ন, সব প্রকাশনীকে এর আওতা আনতে হতো, তাই তিনি সবার সাথে ডিল করেছেন। কিন্তু যখন তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, এবং ধর্মীয় ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন, খুব সহজেই তিনি অভিজিৎ রায়ের বই বাদ দিতে পেরেছেন। এটি তার পক্ষে আরো সহজ হয়েছে, কারণ তিনি রকমারি শুরুই করেছেন ধার্মিক মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু এখনকার যে ইস্যু, সংশয়ী থেকে ধার্মিক হয়ে উঠার গল্প, সেটি সামনে আনতে হয়েছে কেবল একটি কারণেই, সেটি হচ্ছে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা। ওই যে, সেই পয়েন্টা, নিজেকে ‘ধর্মবিরোধী নই’ প্রমাণের জন্য তাকে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। অভিজিৎ রায়ের বই সরানো তার প্রথম উদ্যোগ, ধর্মীয় বই প্রমোট করা তার দ্বিতীয় উদ্যোগ, এবং সাম্প্রতিক প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি তার তৃতীয় ও সবচেয়ে বড় উদ্যোগ!
১২. ঘটনাক্রম থেকে আমরা যে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারলাম, সেগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় সবকিছুকে নিয়েই ব্যবসা করা যাচ্ছে এখন। ব্যবসায়ী হিসেবে মাহমুদুল হাসান সোহাগ অতি বুদ্ধিমান, তবে ব্যবসার স্বার্থে তিনি যে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তিনি মার্কেটিং পলিসি নির্ধারণ করেছেন, সেটি অত্যন্ত ভয়ংকর। একজন ব্যবসায়ী তার গ্রাহকদের একটি অংশকে খুশি করতে গিয়ে আরেকটি অংশের সাথে ‘নীতিভঙ্গ’ আচরণ করেছেন। তাতেও যখন কিছুটা ছাপ থেকে যাচ্ছে, তিনি খোলামেলাভাবে নিজেকে ‘প্রমাণ’ করতে হচ্ছে মিথ্যাভিত্তিক ঘটনাক্রম ও যুক্তি সাজিয়ে।
১৩. এতে এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে যদি কেউ সংখ্যাগরিষ্টের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো বিষয় নিয়ে লিখেন, তাহলে তাকেও একইভাবে বাদ দেওয়া হবে। যদি তাই হয়, তাহলে এমন কোনো ‘বই আন্দোলন’ এর প্রয়োজনটাই বা কী? আমি এখানে তিনটি বিষয় ফোকাস করতে চাই।
প্রথমত: ব্যবসায়িক পলিসি নির্ধারণে তিনি যে ভয়ংকর খেলায় নেমেছেন, তাতে অবশ্যই তিনি একটি বিশেষ গোষ্টিকে প্রভাবিত করছেন অন্য একটি গোষ্টির প্রতি ‘অমানবিক’ হয়ে উঠতে। কারণ, তিনি যে বিশ্বাসের দিকে মুভ করেছেন, তারই সহযাত্রী উগ্রপন্থিদের মনোবাসনাকেই তিনি বিজনেস পলিসির মধ্যে ঢুকিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত: পুরো গল্পটি যেহেতু মোটামুটি তার সাজানো, এবং নিজেকে ‘ধার্মিক’ প্রমাণের চেষ্টার ফলাফল, তাই তার গল্পের প্রত্যেকটি বিষয়ই গোছানো হলেও, দিনশেষে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছে। আমি উপরে সেসবের বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। কিন্তু এটি তার শ্রোতারা ভেবে দেখবে না অধিকাংশই। বিশেষ করে তরুণরা। তারা অনেকগুলো ভুল ও গোজামিলকেই ‘সেরা’ হিসেবে গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবে। এতে ক্ষতি হবে চিন্তার, বিকাশের, সুস্থ্য চর্চার। আমি আশা করবো, এইসব ছাড়াই তিনি সফল হিসেবে থাকবেন। অন্তত ব্যবসায়িক পলিসিতে এমন একজন মেধাবী মানুষের এতো নৈতিক স্থলন খুবই দুঃখজনক।
তৃতীয়ত: এমন নীতিহীন কোনো প্লাটফর্মে আমি ভবিষ্যতে আমার কোনো বই রাখতে চাই না। কোনোভাবেই না। যদিও এতে ‘হাজার কোটি এসেট ভেলুর অধিকারী’ কোনো গোষ্টির কিছুই হবে না, তবু এটা আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে প্রতিবাদ। যতোদিন না তাদের এমন নীতির পরিবর্তন না হচ্ছে।
১৪. ব্যক্তিগতভাবে মাহমুদুল হাসান সোহাগ একজন বিনয়ী ও পেশাদারী ব্যবসায়ী। তবে তিনি যে বিজনেস পলিসির প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন সম্প্রতি, সেটি ভয়ংকর। তার জন্য না হলেও, অনেকের জন্য। আমি এ ব্যাপারে তার বোধদয় আশা করতে পারি বড়জোর। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
১৫. সবশেষে, যারা চিন্তাশীল, সমাজ পরিবর্তনের আশা করেন, কোনো- না-কোনোভাবে, লিখে বা না-লিখে, গেয়ে বা না-গেয়ে, যে ভাবেই হোক, আমরা যদি মানসিকভাবে সৎ না হই, তাহলে সেসবের কোনো কিছুরই বড় কোনো কার্যকারীতা নেই আসলে। বিশেষ করে, কাজে কর্মে আর তার প্রয়োগমূলক ব্যাপারে যদি সৎ থাকা না যায়, তাহলে সেই জ্ঞান, চিন্তা আর বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলো খোলস ছাড়া আর কিছুই না। যার যার জায়গা থেকে সৎ থাকুন। তার চিন্তা করুন, কবিতা, গান, আর্ট, কালচার, যা ইচ্ছা করুন।
কিন্তু আমরা সব বিক্রি করে দিচ্ছি সময়ের দোহাই দিয়ে। না পারার অক্ষমতার কথা বলে। আপস করছি অহরহ। আপসই যদি নীতি হয়ে ওঠে, তাহলে সাইনবোর্ড টাঙিয়েই সেই নীতির কথা বলুন। সাইনবোর্ডে কেন তবে সুন্দর সুন্দর শিল্প, সাহিত্য, আর্ট, কালচারের কথা বলেন, বা লিখেন?
সবার বোধদয় হোক।"
লেখক: আনসারি তৌফিক (https://www.facebook.com/sntowfiq)
...
যখন শিক্ষক, মাহমুদুল হাসান সোহাগ:
No comments:
Post a Comment