লেখক: Badsha Khaled Apu https://www.facebook.com/khaled.h.apu (লেখকের লিখিত অনুমতিক্রমে প্রকাশিত)
"'ইউ-এস বাংলার' চেয়ে বিমানের টিকেট ছয় হাজার টাকা বেশী দিয়ে কেনার পর যখন ফ্লাইট পাঁচ ঘন্টা ডিলে হয় এবং চোখের সামনে দিয়ে 'ইউ-এস বাংলার' যাত্রীরা ঢং-ঢাং করতে করতে চলে যায় (তারা স্বাভাবিক ভাবেই যাচ্ছিল, আমার কাছে ঢং ঢাং লাগছিল আর কি!) তখন মেজাজ যতটুকু খারাপ হবার কথা, আমার মেজাজ ঠিক ততটুকুই খারাপ হয়েছে।
গরম ভাতের হাঁড়ির মত উতরাতে থাকা মেজাজকে বললাম, 'কন্ট্রোল, উদয় ভাই কন্ট্রোল'। বিমানের পাইলট তো আর মোফাজ্জল না, যে আমি তাকে দাবড়ানি দেব আর সে প্লেনের এক পাখা ছাড়াই প্লেন চালিয়ে আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাবে। এখানে কিচ্ছু করার নাই। আমি মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য মানুষ দেখা শুরু করলাম।
চার জনের একটা গ্রুপ আসলো। বোর্ড এর দিকে তাকায়ে একজন বলল, 'কিইইই…সাড়ে চাইর ঘন্টা লেট'!
চারজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক জন চোখ বড়-বড় করে উত্তর দিলো, 'গো...মাইরা দিছে রে-এ-এ! কইছিলাম তরারে, আরেকবার হাত পাও টিপায় যাই। মজা লাগলো না ত। খালি পেলেন ছাইড়া দিবো-পেলেন ছাইড়া দিবো। ছাড়লো না তরার মা... পেলেন'!
অন্য সময় গালিগালাজ শুনলে বিরক্ত হতাম। এখন কেন যেন ভালই লাগলো। কি কিউট করেই না মুখ গোল করে 'গো...' শব্দটা উচ্চরণ করলেন। মনে হচ্ছে যেন বানান করে-করে গালি দিচ্ছে। ইশ-শ, বিমানের চেয়ারম্যান সাহেব যদি এটা শুনতে পারতেন!
আরেক দম্পতি মনে হয় বেড়াতে এসেছিলেন এখন ফিরে যাচ্ছেন। জামাই বেচারা ফ্লাইট ডিলে শুনে আর তার বউয়ের দিকে তাকাতে পারছেন না। ভদ্রমহিলা অদৃশ্য কেশর ফুলিয়ে গনগনে চোখে তার জামাই’র দিকে আগুনের হল্কা ছুড়ে দিতে-দিতে বলছেন, 'এক’শ বার না করসিলাম তোমাকে। পন্ডিতি করে বিমানে টিকেট কাটছো। আমার বাবা কোনদিন আমাকে নেটিভ ফ্লাইটে চড়ায় নাই। ঢাকায় চলো একবার, তারপর...'!
জামাই বাবাজি ম্রিয়মান গলায়, 'শোনো না, তুমি আমার কথাটা একটু শোনো...'।
অদৃশ্য কেশর বললেন, 'আর একটা কথা বলবা না তুমি'।
এই যে ভদ্রলোক বিমানে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর কারণে বউয়ের কাছে মুড়ির মত 'পোতায়ে' গেলেন (এটার শুদ্ধ শব্দটা সম্ভবত ‘নেতিয়ে গেলেন’ হবে। কি জানি এ মুহূর্তে মনে পরছে না)। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে হয়তো লিখতেন,
-আমাদের বাবা আজ অন্ধ
তার দেখা হয় না কিছুই
এই বউয়ের কাছে জামাইটার মান সম্মান
তাকে আর কেউ কোন দিন ফিরিয়ে দেবে না।-
আমাদের এগুলো দেখার আদৌ কেউ আছে কিনা আমার জানা নেই। বিমানের ফ্লাইট ডিলে হবার ঘটনা আজকে নতুন না, আমার অভিজ্ঞতাও এই প্রথম না। অব্যবস্থাপনা, টিকেট ইস্যুতে কারসাজি, অল টিকেট বুকড দেখানোর পরও অনেক সিট খালি যাওয়ার ঘটনা ঘটে আসছে দিনের-পর-দিন। লোকসান দিয়ে আসছে সরকারি এয়ারলাইনস।
কিছু হলেই আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করুক। তাঁর কী আর কোন কাজ নাই! সব কিছুই তাকে দেখা লাগবে! সেদিন দেখলাম এক ভদ্রলোক সি এন জি’তে ভুলে তার ব্যাগ ফেলে এসেছেন। সেটা ফিরে পেতে তিনি ফেসবুক লাইভে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কী কিউট এক জাতি আমরা! কিছু হলেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আর কি-ই বা করবো বলেন। আর কাকেই বা চিনি আমরা, কার কাছে গেলে অব্যবস্থাপনার সমাধান হবে আমরা তো তা জানি না। আর জানলেও সমাধান পাইনি বহুকাল ধরে।
আমি এখন ফেসবুক লাইভে গিয়ে ফ্লাইট ডিলে হওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করবো কিনা বুঝতে পারছি না। ধরেন, করেই ফেললাম! তারপর আগামীকাল সকালে বিমান কর্তৃপক্ষ থেকে আমি-সহ আজকের ফ্লাইটের সব প্যাসেন্জারের কাছে আজকের অনাকাঙ্খিত বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে একটা করে মেইল গেলো। কী দারুণ হতো না বিষয়টা! কাজ নাই তো কোন তাই উল্টাপাল্টা ভাবা শুরু করেছি। মেজাজ দেখি আবার গরম হয়ে যাচ্ছে। কন্ট্রোল, বাদশা ভাই কন্ট্রোল।
এমনিতে আমার আকাশযান ভীতি আছে। আমি দেশের বাইরে তেমন একটা যাই না। যদি-বা যাই, লম্বা ফ্লাইট হলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকি। জানি না কেন ঘুম ভাঙলে ইচ্ছা করে জানালা দিয়ে একটা লাফ দেই। সেই সাথে আছে ইমিগ্রেশন ভীতি, কাস্টমস ভীতি! আগের দিন সাধারণত আমার ঘুম হয় না। মনে হয় সকালে আমি উঠতে পারব না। তাই সকালের ফ্লাইট নেই না সহজে।
ধরেন, বিদেশ থেকে ফিরছি। অহেতুক বুকের ভিতরে ধুকপুক করতে থাকে। মনে হয় গেইটের পুলিশ আমার পাসপোর্ট দেখে বলবে, 'ইউ হলি কাউ, তুমি উগান্ডার ভিসা নিয়া সিংগাপুর আইছো ক্যামনে? ড্যাম ইট'!
দুরুদুরু বুকে সেই গেইট পার হয়ে বোর্ডিং নিতে যাই। মনে হতে থাকে কাউন্টারে বসা ওই মেয়েটা আমার লাগেজ ওয়েট মেশিনে দিয়ে বলবে, 'তোমার লাগেজ পাওনা ২৫কেজি। আছে ৭৪কেজি। দাও একটা কিডনি কাইটা দিয়া যাও। অথবা দাও এক চুমুক রক্ত খাই'। বলে ড্রাকুলার মত দুই দাঁত বের করে উঠে আসবে।
আমি দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে দৌড় দিব।
সেখান থেকে রক্ষা পেয়ে ফাইনাল সিকিউরিটি চেক-ইন। জুতা, ঘড়ি, বেল্ট, মোবাইল, মানিব্যাগ সব ট্রেতে দিয়ে নিরাপত্তা দরজা পার হতে গিয়ে আমার মনে হবে, সামনে গিয়ে আমি যখন পাখির মত আমার দুই হাত দুই দিকে ডানা মেলে দেব, নিরাপত্তা কর্মী মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে আমার দেহ তল্লাশি করতে থাকবে। কোমরে বেল্ট না-থাকায় মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে আমার প্যান্ট খুলে নীচে নেমে যাবে। হাত উপরে উঠিয়ে রাখার কারণে আমি আমার নিজের ইয়েটাও রক্ষা করতে পারবো না।
তারা আমাকে ‘এরেস্ট হিম’ বলে ধরে নিয়ে যাবে। আমি বারবার অনুনয় করে বলতে থাকব, প্লীজ আমাকে একটু মাফ করে দেন। আর কখনো আমি এমন প্যান্ট পরব না। এরপর থেকে আমি ফিতা লাগানো প্যান্ট পরে আসবো। টাইট করে গিট্টু মেরে রাখবো। প্লীজ ফরগিভ মি। কে শোনে কার কথা! তারা আমাকে ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের কোন-এক আদিবাসী দ্বীপে কারাদন্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। আমার সেখানে গিয়ে পাথর ভাঙার কাজ করতে হবে।
এই সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমি এখন শেষ দরজার পাশে বসে আছি। সাড়ে চার ঘন্টা লেট করে 'বিমান হুজুর' আসছে। তারে ত্যাল-ট্যাল মালিশ করা হচ্ছে। একটু পরেই আমরা উঠবো ইনশাহ্ আল্লাহ। উঠেই আমি একটা লম্বা ঘুম দেব।
পাঁচ বছর পরে হোক আর পাঁচ দিন পরে হোক দেশে ফেরার মধ্যে ব্যাপক আনন্দ আছে। বাসায় গিয়ে রাতের বেলায় চেয়ারে পা উঠিয়ে করলা ভাজি আর গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাব। ভাত মাখাতে মাখাতে আম্মাকে বলবো, 'দুইটা শুকনা মরিচ একটু গরম তেলে ভাইজা দাও তো আম্মা। আর ইয়ে, একটা কাঁটাচামচ দিও। বিদেশ গিয়ে এই এক অভ্যাস হইছে কাটা চামচ ছাড়া ভাত খাইতে পারি না। কবে আবার তোমারে মাম্মি-টাম্মি ডাইকা বসি তার ঠিক নাই। তুমি আবার এসবে মাইন্ড কইরো না প্লীজ।"
No comments:
Post a Comment