Search

Wednesday, September 4, 2024

গণভবন হোক গণমানুষের!

লেখক: Ridwan Anam (https://www.facebook.com/ridwan.anam)
 
"জুলাই-অগাস্ট ছাত্র জনতার বিপ্লবের স্মৃতি চির অম্লান রাখতে একটা আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর গড়ে তোলা অবশ্যই প্রয়োজন। এবং সে জাদুঘর যদি শেখ হাসিনার ১৬ বছরের ভয়াবহ অপশাসনের কেন্দ্রবিন্দু, দুর্ভেদ্য গণভবনে হয়, তার চেয়ে সুন্দর পোয়েটিক জাস্টিস আর হয় না।
সেই জাদুঘর হোক স্বৈরাচার আর জুলাই বিপ্লব স্মৃতি জাদুঘর। এ জাদুঘরের লক্ষ্য হোক এক কথায় ১৬ বছর ব্যাপী স্বৈরশাসনের ইতিহাস, গুম-খুনের ইতিহাস, সীমাহীন দুর্নীতির ইতিহাস, মানুষের কণ্ঠরোধ করার ইতিহাস, প্রশাসন পুলিশ আর দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করে গণহত্যার ইতিহাস সংরক্ষণ।
এই জাদুঘর বানাতে হলে সবার আগে গণভবনের উঁচু দেয়ালগুলো ভেঙ্গে ফেলে দিতে হবে। গণভবন হবে সত্যিকারে 'গণ' অর্থাৎ পাবলিক বা আমজনতার ভবন। নিরাপত্তার খ্যাতিরে লোহার শিকের বেড়া আর গেইট থাকবে, কিন্তু সে বেড়া আর গেইট হবে see through অর্থাৎ বাইরে থেকে যে কেউ ভিতরে কি আছে, কি হচ্ছে সব কিছু চোখের সামনেই দেখতে পারবে।
 
গণভবনে ঢোকা মাত্র চোখের সামনে একটা ফলক থাকবে। সেখানে লেখা থাকবে গণভবন কিভাবে তৈরি করা হয়েছিলো, কতো একর জমি, বানাতে কতো খরচ হয়েছিল, এতে কি কি সম্পদ আছে (গাছ, পুকুর ও অন্যান্য) তার হিসাব।
সবার নিচে লেখা থাকবে, এই গোটা ভবন আর তার সব সম্পদ শেখ হাসিনা মাত্র এক টাকার বিনিময়ে নিজের নামে নিয়ে নিয়েছিলো। সেই এক টাকায় নিয়ে নেওয়া প্রজ্ঞাপনের ছবি ফলকে থাকবে।
কোন রকম টিকেট ছাড়াই যে-কেউ প্রদর্শনীর নির্ধারিত সময়ে গণভবনে প্রবেশ করতে পারবেন, ইচ্ছামতো ঘুরতে পারবেন, ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারবেন। গণভবনে প্রবেশ করার সঙ্গে-সঙ্গে যে-কোন বাংলাদেশী নাগরিক অনুভব করবেন তিনি একজন স্বাধীন আর মুক্ত নাগরিক।
 
গণভবনের জাদুঘরের প্রদর্শনী শুরু হবে শেখ হাসিনা কিভাবে কোন উপায়ে একছত্র একনায়ক হয়েছিলো, কোন উপায়ে সে সব স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছিলো তা দিয়ে। এইখানে কুখ্যাত ত্রয়োদশ সংশোধনী আর খায়রুল হকের (আমি ইচ্ছা করেই এই দেশ ধ্বংসকারী লোকের পদবী উচ্চারণ করলাম না) নাম আসবে, তারা কোন উপায়ে ঠুনকো অজুহাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে হাসিনার জন্য অনন্ত স্বৈরশাসনের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো তা তথ্য প্রমাণসহ দেখানো হবে।
 
কিভাবে পর-পর তিনটা ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচন করে ২০ কোটি বাংলাদেশী নাগরিকের ভোটাধিকার নির্লজ্জভাবে ডাকাতি করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটা দেখানো হবে। এই তিন নির্বাচন আয়োজক কলংকিত তিন নির্বাচন কমিশনের প্রত্যেক সদস্যের নাম পরিচয় আর ছবি থাকবে।
কিভাবে প্রতিটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্লজ্জ দলীয়করণ করে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, সেটা একে-একে দেখানো হবে৷ সব যোগ্যতা থাকা সত্বেও যোগ্য বিচারকদের পদোন্নতি না দিয়ে অযোগ্য বিচারক নিয়োগ করে বিচারব্যবস্থা কিভাবে ধ্বংস করেছিলো সেটার তথ্য উপাত্ত থাকবে।
 
দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখানো হবে গুমের ইতিহাস। এখানে আয়নাঘরের একটা রেপ্লিকা দেখানো হবে। 
টর্চার রুম সহ আয়নাঘর কি ভয়াবহ একটা জল্লাদখানা ছিলো, প্রত্যক্ষদর্শী আর ভিক্টিমদের জবানবন্দী সহ দেখানো হবে। কারা কারা আয়নাঘরের কারিগর ছিলো তাদের নাম আর ছবি আর চেইন অফ কম্যান্ড সহ দেখানো হবে।
 
তৃতীয় পর্যায়ে দেখানো হবে ক্রসফায়ারের ইতিহাস।  

সিরাজ শিকদার, জাসদের কর্মীদের বিচারবর্হিভূত হত্যা থেকে শুরু করে র্যাব গঠন করার পর কিভাবে ক্রসফায়ার ফিরে আসলো তা তথ্য প্রমাণ সহ দেখানো হবে।
 
এরপর আওয়ামী লীগ ২০০৯ এ ক্ষমতায় আসা মাত্র ক্রসফায়ারকে কিভাবে বিরোধীমত দমন নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে লুফে নিয়ে কিভাবে সব বিরোধিতাকে গুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিলো তা উপাত্ত, পরিসংখ্যান, কেস স্টাডি সহ থাকবে। র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন, গুলিতে বুক ঝাজরা হয়ে যাওয়া বিএনপি নেতা জনি, কাউন্সেলর একরাম, মেজর রাশেদ সিনহা সহ আলোচিত প্রতিটা বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড তুলে ধরা হবে।

চতুর্থ পর্যায়ে থাকবে বাকস্বাধীনতা দমনের ইতিহাস। সাইবার সিকিউরিটি এ্যাক্ট বা ডিএসএ-এর মতো দানবিক 'ড্রাকোনিয়ান' আইন দিয়ে কিভাবে আমাদের মুখ চেপে ধরে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেছিলো!

কিভাবে মানুষকে এক লাইনের একটা পোস্ট লেখার জন্য মাসের পর মাস জেলে পচতে হলে, কিভাবে কার্টুনিস্ট কিশোর আর মুশতাককে কার্টুন আঁকার অপরাধে জেলে যেতে হলো, কিভাবে নির্যাতন করে কুমীর চাষী মুশতাককে মেরে ফেলা হলো, কিভাবে খাদিজাতুল কুবরার মতো নাবালিকাকে সামান্য একটা টক শো সঞ্চালনা করার অপরাধে ১৮ মাস জেলে রাখলো, সব দেখানো হবে।

সেই সাথে হাসিনা কিভাবে প্রতিটা নাগরিকের পেছনে গোয়েন্দা লেলিয়ে দিতো, কিভাবে সব ফোনে নির্লজ্জভাবে আড়ি পাততো সেটাও এখানেই দেখানো হবে।
একই সাথে পা চাটা দালাল মিডিয়া কিভাবে এই বাকস্বাধীনতা দমনের সহায়ক ছিলো, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সগুলোর ভিডিও সহ দেখানো হবে।
 
পঞ্চম পর্যায়ে থাকবে দুর্নীতির ইতিহাস। হাসিনা আর তার পেংগুইনেরা যে অকল্পনীয় দূর্নীতির সিস্টেম করে গিয়েছিলো, কিভাবে ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার ধ্বংস করে জনগণের সম্পদ লুট করেছিলো কিভাবে ১০০০ কোটি টাকার প্রকল্প ৫০০০ কোটি টাকায় উঠেছিল, সরকারি কর্মীরা কি রকম সীমাহীন দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছিল তা এনবিআরের মতিউর, পুলিশের বেনজীর, ড্রাইভার মালেকদের মতো মহাকীর্তিমানদের কীর্তি প্রদর্শন করা হবে।
এটা এতো বিশাল একটা ক্ষেত্র, এবং এতো অসংখ্য দুর্নীতির অকাট্য প্রমান আছে যে শুধুমাত্র ১৬ বছরের দুর্নীতির ইতিহাস নিয়েই আলাদা একটা মিউজিয়াম করে ফেলা সম্ভব।
 
ষষ্ঠ পর্যায়ে থাকবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আর স্বৈরাচার হাসিনার গণহত্যার ইতিহাস। পিলখানা গণহত্যার ইতিহাস থেকে এ ইতিহাস শুরু হবে।
এরপর শাপলা চত্বরের হেফাজত কর্মীদের গণহত্যা, মাওলানা সাইদীর মুক্তির দাবীতে রাস্তায় নামা মানুষদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা থেকে শুরু করে ২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের অকল্পনীয় নারকীয় গণহত্যা, প্রতিটা হত্যাযজ্ঞের ছবি, ভিডিও, তথ্য উপাত্ত পরিসংখ্যান সহ দেখানো হবে।
 
সঠিক আর বাস্তব পরিসংখ্যান এই ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিহত আহত সবার নাম পরিচয় ছবি, তাদের পরিবার সদস্যের স্মৃতিচারণ সহ প্রদর্শন করতে হবে।
বিশেষভাবে হাসিনা তার পুলিশ আর কর্মী লেলিয়ে কতোজন নিষ্পাপ শিশুকে মারণঘাতী এসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, মেশিনগান, হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করে খুন করেছিলো, সেটা তাদের ছবিসহ মিউজিয়ামের একটা দেয়াল জুড়ে থাকবে।
 

হাসিনার পুলিশ বাহিনী নাজি পার্টির গেস্টাপো আর এসএস বাহিনীর মতো গভীর রাতে এলাকার পর এলাকা কিভাবে রেইড দিতো সেটা দেখানো হবে।
সর্বোপরি এই গণহত্যার পিছনে কারা কুশিলব, কারা সরাসরি অংশগ্রহণকারী, কারা ইন্ধনদাতা, কারা নির্দেশদাতা তাদের চিহ্নিত করে মিডিয়ায় দেওয়া তাদের বক্তব্য জাদুঘরের এই অংশে দেখানো করা হবে।
 
এতোক্ষণে আমরা গণভবনে বানানো জাদুঘরের শেষ অংশে এসেছি। সব দেখা শেষ করে, সব ইতিহাসের চাক্ষুস সাক্ষী হয়ে, জাদুঘরের অতিথিরা গণভবনের উন্মুক্ত প্রান্তরে এসে হাজির হবে। এই মাঠের মাঝখানে পতপত করে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মাঠ ছেয়ে থাকবে অসংখ্য ছোট ছোট নাম ফলক দিয়ে।
সেই ফলকগুলোর প্রথম ফলকের নামটা হবে শহীদ আবু সায়ীদের। ফলকের গায়ে তার ছবি, সাথে সংক্ষিপ্ত পরিচয় থাকবে। পাশেই একে একে থাকবে শহীদ মীর মুগ্ধ, শহীদ ফারহান, শহীদ তাহমিদ, শহীদ ওয়াসিম, শহীদ ইয়ামীন, শহীদ হৃদয় তরুয়া সহ প্রত্যেক শহীদের নাম ফলক।
আমরা এই স্থানে এসে নিশ্চুপ হয়ে যাবো। কতো অশ্রু আর রক্তের বিনিময়ে আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছি তা সরাসরি অনুভব করতে পারবো।
সেই সাথে আমাদের মনের গভীরে শপথবাণী উচ্চারিত হবে, ইনশা আল্লাহ আর কখনই আমরা কোন স্বৈরশাসকের অধীন হবো না!
নেভার এগেইন!"
 
-লেখক: Ridwan Anam

No comments: