"আমীরে জামাত মেয়েদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যমুনা টিভিকে বলেছেন:
'আফগানিস্তানে একচুয়ালি কী হচ্ছে, এটা আপনিও চোখে দেখছেন না, আমিও দেখছিনা, শুধু মিডিয়ার মাধ্যমে খন্ডচিত্র আমাদের কাছে যেটুকু আসে তাই নিয়ে আমাদের ধারণা।'
মিডিয়া যে একটা চরম হিপোক্র্যাট এবং সে যে সিলেক্টিভ পিকচার দেখায় মানুষকে, এখাতে আমীরে জামাতের কথায় আমি ১০০% একমত।
এমনকি এমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এ ব্যাপারে একমত।
ট্রাম্পের যা পছন্দ হয় না, সবকিছুতে সে নির্দ্বিধায় বলে দেয় 'মিডিয়া ফটোশপ করছে'।
ট্রাম্পের সমর্থকদেরকে আপনি ট্রাম্পের কোনো অপ্রীতিকর কাজ/ভিডিও/ অডিও যত সলিড এভিডেন্সই দেখান, ওরা দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আপনাকে নির্দ্বিধায় বলে দিবে, এগুলো মিডিয়ার বানানো।
কথা কিন্তু মিথ্যা না।
মিডিয়া যে কতটা ভয়ানক হিপোক্র্যাট হতে পারে, বিশেষ করে মুসলিমদের নিউজের ক্ষেত্রে তা আমরা দিব্যচোখে প্রতিদিন দেখি প্যালেস্টাইন ইস্যুতে। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
মিডিয়া আপনাকে খন্ডচিত্র দেখাতে পারে, মিডিয়া আপনাকে মিথ্যাকে সত্য করে দেখাতে পারে; কিন্তু বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে যে আফগান কমিউনিটি, আফগানিস্তানের বাইরে এই যে আফগান এক্টিভিষ্টসরা, এরাও কী সবাই খন্ডচিত্র দেখাচ্ছে?
অথবা তালেবানরা যে ল' জারী করেছে, '৩১ জুলাই ২০২৪'- 'ক্বানুন আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার'।
যার আর্টিক্যাল ১৩-তে যে 'আহক্বামে হিজাব এ জান' [*]-এ মেয়েদেরকে কীভাবে তাদের একদম আগাগোড়া ঢেকে পর্দা করতে হবে। শুধু তাই-ই না, মাহরাম ছাড়া সে পাবলিক স্পেইসেই যেতে পারবে ন! এই ল'-এর কপি যদি আমীরে জামাত চান, আমি উনাকে পাঠাতে পারি।দুনিয়া জুড়ে মেয়েদের অবস্থা নিয়ে আগ্রহ থেকেই আমি আফগানিস্তানের সরকারী প্রজ্ঞাপন থেকেই এই আইনের কপি কালেকশান করেছি। ট্রাম্পও মিডিয়ার হিপোক্র্যাসিকে নিজের সুবিধার্থে খেলে।
আমীরে জামাতও মেয়েদের প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে সেইম খেলা খেললেন। এক বারের জন্যও ভুলেও তিনি বললেন না- যদি পাবলিক স্পেইস থেকে মেয়েদেরকে আসলেই (ধরে নিলাম উনি এই আইনের কপিকেও বিশ্বাস করেন না, তারপরও হাইপোথ্যাটিক্যালি) এমন কন্ডিশনাল করে দেয়া হয়, ঘর থেকে বের হতেই তার মাহরাম লাগে, তাহলে তা যে জামাত করবে না বা জামাত যে এতে নিন্দা জানায় এই কথাটা কিন্তু তিনি বলেন নাই!
কীভাবে বলবেন? জামাতের ভিতরে মেয়ে/ মহিলাদের মোবিলিটি লিমিট কতটুকু, তাতো আমরা খুব ভালো করেই জানি। সোশ্যাল মোবিলিটির অনুমতি মেয়েদেরকে ঠিক ততটুকুই জামাত দেয় যতটুকু দিলে সে মেয়েদের মধ্যে সংগঠনের মিটিঙে যেতে পারবে; মেয়েদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ করতে পারবে, বায়তুলমাল তুলতে পারবে।
আর ক্যারিয়ার?!
জামাতের ভিতরে মেয়েদের ক্যারিয়ারকে কীভাবে 'দ্বীনের জন্য কুরবান' করে দেয়া হয়, তার কাহিনী যদি টান দেই তাহলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। নেত্রী থেকে কর্মী পর্যন্ত কত দেখলাম, বেহিসাবি। আমীরে জামাত নুসাইবা রাঃ এর উদাহরণ দিয়েছেন।
যুদ্ধে রাসুল (সা.)-কে নুসাইবা (রা.) রক্ষা করতে গিয়ে তীরের আঘাত শরীর পেতে নিয়েছিলেন। সেই তীরের আঘাত নেয়ার জন্য নুসাইবা (রা.) সেখানে রাসুল (সা.) এর ফিজিক্যাল প্রক্সিমিটিতে উপস্থিত ছিলেন।
হঠাৎ করে উড়তে-উড়তে ঠিক তীরের আঘাতের সময় এসে তীরের আঘাত তিনি শরীর পেতে নেননি, তা নেয়ার জন্য ওখানে উনার উপস্থিতি ছিলো, এ নিশ্চিত।
শুধু নুসাইবা (রা.) একলাই না, আরো মেয়ে সাহাবারা ছিলেন। রাসুল (সা.) অলমোষ্ট যত পাবলিক স্পেইসে ছিলেন, মেয়ে/ মহিলারাও একই পাবলিক স্পেইসে ছিলেন। তারা অদৃশ্য ছিলেন না।
জামাতের নেতাদের সঙ্গে কয়জনের ওয়াইফদেরকে নেতাদের সাথে মানুষ পাবলিক স্পেইসে দেখে?!
মিটিং-এর কথা নাহয় বাদ দিলাম। একদম সাধারণ যাপিত জীবনে, কোথাও, লাইক এনিহোয়ার এট অল, কোথাও দেখেছেন কেউ, জামাত লিডার মানুষের সাথে কথা বলছেন, বা কোথাও আছেন, উনার পাশে উনার ওয়াইফ আছেন? বা উনার মেয়ে আছেন? বা উনার আশেপাশে কোন মেয়ে আছেন কোথাও?
(একমাত্র হাসিনা খালেদার সাথে মিটিং এর ছবি ছাড়া!)
যুদ্ধে যেখানে মেয়েদের উপস্থিতি ছিলো রাসুল (সা.) এর সময়ে, যেখানে যুদ্ধে হারার সম্ভাবনা ছিলো, এবং হারলে তখনকার সেই সময়ে মেয়েদেরকে দাসী করে নিয়ে যাওয়া হত। নাকি জামাতের লোকজনের মনে হয় সেই দাসী হিসেবে বন্দী হওয়ার যে রিষ্ক, বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর নেতাদের সাথে তাদের ওয়াইফরা যদি পাবলিক স্পেইসে আসেন বা মহিলা জামাত/ ছাত্রী সংস্থার মেয়ে/মহিলারা পাবলিক স্পেইসে আসলে তার চেয়ে বেশী রিষ্ক?
ওহ, স্যরি, উনারা রিস্ক শব্দটা বলেন না, উনারা বলেন 'ফিতনার সম্ভাবনা'।
আমার প্রশ্ন, তারমানে আল্লাহ্র' রাসুল (সা.) এর সময়ে যে ফিতনার সম্ভাবনা ছিলো, যে ভয়ংকর অবস্থা ছিলো, জামাতের দৃষ্টিতে কি এখনকার অবস্থা তার চেয়েও ভয়ংকর?
আমি তাই আমীরে জামাতের সুরেই সুর মিলিয়ে বলতে চাই, মানব জীবনের সবচাইতে কঠিন কাজের নাম হচ্ছে যুদ্ধ, সেই ময়দানেও যখন মহিলারা অংশগ্রহণ করেছেন। তাহলে সম্মানিত আমীরে জামাত, কেনো আপনাদের মেয়ে-মহিলাদেরকে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধের ময়দানে না দেখুক, অন্তত পাবলিক স্পেইসে কোন উপস্থিতিতেই কেনো দেখে না?
কই, আপনাদের এই যে লক্ষ-লক্ষ মেয়ে কর্মী, নেত্রী- তাদের পাবলিক মিটিং, পাবলিক উপস্থিতি এই সব কিছুই তো দেখি না আমরা। তারা কী ভূতের মত! অদৃশ্য? জ্বীন!
ঠিক আফগানিস্তানের এই যে নতুন আইন এসেছে 'আহক্বামে হিজাবে জান', এটাই কি আপনাদের দলের চর্চা না? পার্থক্য শুধু এখনো যেহেতু ক্ষমতা পাচ্ছেন না আপনারা, তাই নেক্বাব পরে মেয়েদের মধ্যে দাওয়াতী কাজ আর মেয়েদের মধ্যে মিটিং-এ যাওয়া এলাউ করেন।
যে মুহুর্তে আপনারা ক্ষমতা পেয়ে যাবেন, সেই মুহুর্তে যখন দেখবেন এখন তো 'দাওয়াতী কাজের'(!) প্রয়োজন শেষ, তখন আমরা কীভাবে বুঝবো যে আপনারাও তালেবানদের মতই একই স্টাইলে মেয়েদেরকে ঘরে ঠেলে দিবেন না?
রাসুল (সা.)-এর সময়ে মহিলারা ডাইরেক্ট পাবলিক স্পেইসে আল্লাহ'র রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করতে পারতেন যেখানে, বা আল্লাহ'র রাসুল (সা.)-কে প্রয়োজনে রাস্তায় থামিয়ে কথা বলতে পারতেন, মানুষের সামনে, পাবলিক স্পেইসে। আর আপনাদের দলের ভিতর?
জন্ম থেকেই তো দেখেছি! পর্দার আড়াল থেকেও মেয়ে/মহিলারা ভয়েস দিয়ে কথা বলতে পারেন না। কাগজে লিখে-লিখে পর্দার এই সাইড থেকে ছোট বাচ্চা দিয়ে ওই সাইডে পাঠায়! যেন ওরা বোবা!
আপনাদের যে শূরার মিটিং হয়, আপনাদের মেইন পাওয়ার হাউজের মিটিং হলো পুরুষ রোকনদের শূরার মিটিং। যেখানে কোন মেয়ে বা মহিলার কোন ধরনের এক্সেস নাই।
তারপর আপনারা মহিলা জামাতের আলাদা দুধভাত শূরার মিটিং করেন। আলাদা-আলাদা!
সব আলাদা-আলাদা! যেনো মহিলাদের গলার আওয়াজটাও কেউ না শোনে। কই, আপনাদের যে এত হাজারে-হাজারে রুকন মহিলা জামাতের, অথবা ছাত্রী সংস্থার হাজারে-হাজারে নেত্রী, একজনও তো নেকাব পড়া ব্যতীত নাই! প্রত্যেকের চেহারা নেকাবে ঢাকা।
দলের ভেতর যা আপনারা এত কঠিনভাবে প্র্যাকটিস এবং মেইনটেইন করেন সেই আইডিয়লজিতেই তো দেশ চালাবেন ক্ষমতা পেলে, নাকি?
তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোন মেয়ে/ মহিলা যদি বাই-চান্স কোনোভাবে টপ ম্যানেজমেন্টে উঠেও যায়, আমি খুব সহজেই কল্পনা করতে পারছি:
বোর্ড মিটিং এর মাঝখানে একটা পর্দা ঝুলিয়ে দেবেন। পর্দার ওই সাইড থেকে ওই মহিলা কাগজে টুকরা-টুকরা করে নিজের মতামত লিখে দেবেন। হাত যেন দেখা না-যায়, তাই তিনি ওই কাগজের টুকরা একটা ঝুড়িতে বা কিছুতে দিয়ে সেই ঝুড়ি পর্দার নীচ দিয়ে ঠেলে দেবেন।
আপনি বলেছেন কাউকে কোনো কিছুতেই বাধ্য করা হবে না।আপনাদের দলের ভিতরেই কিন্তু নেকাব না-পরলে রোকন হতে পারে না বা নেকাব না-পরলে ছাত্রী সংস্থার সদস্যা হতে পারে না। এটা কোথাও কিন্তু আপনারা লিখে রাখেন নাই যে, 'নেকাব পড়া বাধ্যতামূলক'; কিন্তু ঠিকই নেকাব না-পরলে দলে সার্ভাইভ-ই করতে পারে না কেউ।
আপনার কথা যদি আমি বিশ্বাস করি; আপনি সত্য বলেছেন। কাউকে বাধ্য করা হবে না। কিন্তু সরকারী চাকরীতে, বেসরকারি পাওয়ার বেঞ্চে, উচ্চতর প্রশাসনিক পদ থেকে শুরু করে মেয়েদের মাদ্রাসার গেটের মেয়ে দারোয়ানের পদ পর্যন্ত- সব জায়গায় যখন অঘোষিতভাবে মানা হবে, নেকাব না-পরলে চাকরির এপ্লিকেশানই কনসিডার করা হবে না, তখন আসলেই কাউকে বাধ্য করার কী দরকার?