|
"গাজীপুর
জেলা কারাগারে আমাকে যেদিন ট্রান্সফার করে, সেদিনই রেজা স্যারকে সেখান
থেকে কাশিমপুর জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
কাশিমপুরে আমি আর সুবায়েল (ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিক) সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পাশাপাশি সেলে ছিলাম। এখন
আমি অন্য কারাগারে চলে এলাম। গাজীপুর জেলে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঘটনাবহুল সময়
কেটেছে। প্রায় এক বছরের মতো সময় ছিলাম।
সে
সময়ে কারাগারের সুপার এবং জেলার দুইটাই ছিল বদের হাড্ডি। সুপারের নাম মোতালেব।
তার ভুঁড়ির পরিধি মাপতে সম্ভবত একশ হাত লম্বা ফিতা লাগবে। এরকম নিষ্ঠুর
এবং বাজে ব্যবহারের মানুষ দুনিয়াতে কমই আছে। ঘুষ ছাড়া সে সম্ভবত নিঃশ্বাসও
নেয় না। তার ডেপুটি অর্থাৎ কারাগারের জেলার তার চেয়েও এক কাঠি সরেস। নাম
আমজাদ হোসেন। দাবী করে ডাকনাম 'ডন'।
আমজাদের
ভাষ্যমতে সে রাজশাহী ভার্সিটির ছাত্রলীগের নেতা ছিল। সেই সূত্রে আমজাদ
ধরেই নিয়েছে তাপস হত্যাচেস্টা মামলার আসামী, বাংলাদেশের শত্রু এবং তার জীবন
অতিষ্ঠ করা আমজাদের পবিত্র দায়িত্ব। আমি এবং হেলাল স্যার একটি সংক্ষিপ্ত
সময়ের জন্য কাশিমপুর কারাগারে পাশাপাশি সেল এ ছিলাম। আমজাদ তখন আমি এবং
হেলাল স্যারের সঙ্গে এহেন বদমায়েশি নাই যেটা করে নাই। এরকম বেয়াদব দু-পেয়ে
প্রাণী আমি আমার জীবদ্দশায় কমই পেয়েছি।
গাজীপুরে
এসে আবার সেই আমজাদকে জেলার হিসাবে পেয়ে আমার জীবন ধন্য (!)। সে প্রথমেই বিসমিল্লাহ
বলে কারা ক্যান্টিনে আমার খাবারের এক্সেস বন্ধ করে দিলো। খুব ছোট্ট একটা
অভিযোগের অজুহাতে এই সিদ্ধান্ত। দুই একবার দরখাস্ত দিয়েও কাজ হয় নাই। সে
কারণে গাজীপুর কারাগারের সময়টাতে আমি জীবনের সবচেয়ে বেশি খাবারের কষ্ট
করেছি। যাক সে কথা। আজকের গল্প ভিন্ন।
আচানক
একদিন গাজীপুর জেলা কারাগারে সাজ-সাজ রব। চারিদিকে এহেন হট্টগোল শুনে
দায়িত্বরত কারারক্ষীর কাছে কারণ জানতে চাইলাম। জানা গেল, আগামীকাল
গাজীপুরের একজন ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা কারাগার পরিদর্শনে আসবেন। তিনি কি
ডিসি নাকি অন্য কেউ, সে তথ্য কেউ দিতে পারল না।
আমার
আর কি! আমি যা ছিলাম তাই। পরদিন ভোরে জেলার আমজাদ আমার সেলের সামনে এসে
হাজির। সে এমনিতেই বেয়াদব। সেদিন খুব স্বাভাবিকভাবেই জানালো:
'ক্যাপ্টেন সাহেব, আজকে গাজীপুর জেলার একজন ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা আমাদের কারাগার পরিদর্শনে আসবেন। তিনি আপনার সেলে আসার ইচ্ছা পোষণ করতে পানরে। আপনি কয়েদী পোশাক পরে রেডি থাকবেন'।
আমি বিনয়ের সাথে বললাম, "জি আচ্ছা। আমি কয়েদী পোশাক গুছিয়ে রেখেছি।"
আমজাদ চলে গেল। আমার
আসলে কয়েদী পোশাক পরিধাণ করা নিয়ে কখনোই কোন সমস্যা ছিল না। এটাকে আমি
ইউনিফর্ম হিসাবে নিতাম। সামরিক বাহিনীর স্যারেরা আমাদের কমব্যাট ইউনিফর্মের
চেয়ে এই পোশাক, আমাদের জন্য অধিকতর যোগ্য মনে করেছেন, আমার পরতে আপত্তি থাকবে কেন!
বেলা ১১৩০
এর দিকে কারাগারে রেড এলার্ট, সেলের দরজা বন্ধ। পরিদর্শন শুরু হয়েছে।
পরিদর্শক সাহেব শুরুতে ডিভিশন প্রিজনার সেলে গিয়েছেন। সেখানে তখন
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী থাকেন। শুরুতে তাঁর সাথে কথা বলেছেন। একটু পর
আমাদের সেল এলাকায় আসবেন বলে জানা গেল।
গাজীপুর
কারাগারের বিশেষ সেল এলাকা একটা দুর্গের মতো। সেলের চারিপাশে বিশাল
প্রাচীর। জেলা কারাগারের প্রাচীরের ভিতরেও আরেকটা প্রাচীর। মনে হয় খাঁচা।
আমি কয়েদী পোশাক পরে, তালাবদ্ধ সেলের দরজার কাছে অপেক্ষমান। বড় কর্তা
আসবেন। একটু পর স্যার এলেন।
চশমা
পরিহিত গম্ভীর চেহারার একজন মানুষ। দেখে ভার্সিটির প্রফেসর মনে হয়। একটু
রাগী। তিনি আমার সেলের সামনে এলে আমি সালাম দিই। তিনি জবাব দিলেন। এরপর কথা
শুরু করলেন।
'আপনার পরিচয়', তাঁর কণ্ঠ গম্ভীর?
আমি কিছু বলার আগেই, আমজাদ আমাকে ডিঙ্গিয়ে, এক পা সামনে এসে বলে, 'স্যার উনি তাপস মার্ডার কেসের আসামী। বিরাট ক্রিমিনাল'।
আমি
কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে এবং আমজাদকে স্তব্ধ
করে দিয়ে, যা বলার সেই স্যার নিজেই বললেন, 'এই জেলার সাহেব, আপনি কথা বললেন
কেন? আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি? আর তাপস মার্ডার মানে কি'?
আমজাদ
হাল ছাড়ার পাত্র না। সে বলে উঠে, 'স্যার তাপস মানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আত্মীয় ব্যারিস্টার তাপস মার্ডার। ঐ যে স্যার
বোমা মেরে হত্যা'।
এবারে
বড় কর্তার গলা আরেক ধাপ উঁচুতে, 'পড়ালেখা করে চাকুরি পেয়েছেন? নাকি পিছনের
দরজা দিয়ে? তাপস মার্ডার মানে কি? তিনি তো দিব্যি বেঁচে আছেন। জেলার হিসাবে
চাকরি করেন অথচ স্পর্শকাতর বন্দী সম্পর্কে কিছুই জানেন না'!
আমজাদ
এমন বকা আশা করে নাই। তাঁর মুখ ব্যাজার। অসুস্থ থাকায় জেল সুপার ভোটু
মোতালেব সেদিন ডিউটিতে নাই। আমজাদই সর্বেসর্বা। এহেন অবস্থায় ঝারি খেয়ে তার
মন খারাপ।
এবারে বড়কর্তা
আমার দিকে ফিরেন। ততোক্ষণে আমার মেজাজ তিতা হয়ে গেছে। আমজাদের এহেন
ব্যবহার পেয়ে আমার বেশিরভাগ দিনই কাটে। কিন্তু বড়কর্তার সামনে এগুলো এভাবে না
বললেও পারত।
বড়কর্তা এবার জিজ্ঞেস করেন, 'ভাই আপনার নাম পরিচয় বলেন'?
আমি জবাব দিই, 'স্যার আমার নাম রাজীব। কয়েক বছর আগে আমি একজন আর্মি অফিসার ছিলাম। এখন কয়েদী রাজীব।"
ভদ্রলোকের চোখে আমি এক ধরনের বেদনা দেখতে পাই। আমার একটু অবাক লাগে। তিনি এবারে জিজ্ঞেস করেন, 'ভাই আপনি কারাগারে কেন? কি হয়েছিল? আমাকে বলা যায়'?
আমার
আর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। আমজাদ যে ভূমিকা দিয়েছে, এরপর কথা বলা সময়ের
অপচয় মাত্র। তাও উত্তর দিই, 'স্যার আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় কারাদণ্ড লাভ
করেছি। বিশেষ কোন কারণ নাই'।
জেলার আমজাদ বড়কর্তাকে ডিঙ্গিয়ে হুংকার দিয়ে ওঠে, 'ক্যাপ্টেন সাহেব, আপনি কিন্তু স্যারের সাথে বেয়াদবি করছেন! পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না'।
এবারে
বড়কর্তা ভয়ানক রেগে যান। তিনি উচ্চস্বরে বলেন, 'জেলার সাহেব, গেট আউট।
আপনি এই মুহূর্তে সেল এলাকার বাইরে যাবেন। আমি বন্দীর সঙ্গে একা কথা বলবো'।
আমজাদ
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে এতোটা আশা করে নাই। সে কিছু একটা বলার চেষ্টা
করে। স্যার আবার বলেন, 'আমি আপনাকে যেতে বলেছি। আর আমি ভিজিট শেষে আপনার
আইজি প্রিজনকে জানাবো। এখন যান'।
আমজাদ ব্যাজার মুখে সেল এলাকা ত্যাগ করে। বড় কর্তা তাঁর আশেপাশের অন্যান্য কারা কর্মকর্তাদের দূরে যেতে বলেন। এরপর আমার দিকে তাকান। আমি গরাদের অপর পাশে স্পষ্টত স্যারের চোখে এক ধরনের তীব্র বিষণ্ণতা লক্ষ্য করি। তিনি থেমে-থেমে বললেন:
'ক্যাপ্টেন রাজীব, কারাগার পরিদর্শনের এজেন্ডায় করনীয় কিছু কাজের মাঝে অন্যতম ছিল, আপনাকে এক নজর দেখা। স্বাস্থ্য খারাপ কেন? খাওয়া দাওয়া করেন না? পিসিতে (পার্সোনাল ক্যাশ- পিসি) টাকা আছে? ক্যান্টিন থেকে কিনে খান না'?
স্যার
এক দমে এতগুলো কথা বলেন। স্যারের কণ্ঠে মমতা। আমার বুকে এক ধরনের বেদনা
হয়। আমি তাঁকে জবাব দিই, 'স্যার আমার পূর্বের আচরণের জন্য দুঃখিত। স্যার, এখানে আমাকে ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনতে দেয় না। উনারা খুব দুর্বল অজুহাত
দিয়ে এই শাস্তি আরোপ করেছেন। জেলের সরকারী খাবার খেতে আমার খুব সমস্যা হয়'।
বড়কর্তা বিষণ্ণ চেহারায় চুপ করে থাকেন। বলেন, 'আচ্ছা আমি বলে দিবো। আর সমস্যা হবে না'।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছেন। 'আহারে বাচ্চা একটা আর্মি অফিসার। কতো কষ্ট'!
আমি স্যারের কথার অর্থ ধরতে পারি না। তবে স্যারের কণ্ঠে সহমর্মিতা। আমার চোখ ভিজে আসে।
এবারে
তিনি এক কদম এগিয়ে কারাগারের গরাদ ধরে আমার পানে সেই বিষণ্ণ দৃষ্টিতে
তাকান, 'ক্যাপ্টেন রাজীব, আমার আপন বড় ভাই পিলখানায় শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁর
লাশ পেয়েছিলাম, ক্ষতবিক্ষত। চেনার উপায় ছিল নাই। আমার ভাই আমাকে অনেক স্নেহ
করতেন'।
এবারে আমি মিলাতে
পারি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উচ্চপদস্থ একজন সরকারী কর্মকর্তা কাঁদছেন।
তিনি তাঁর খুন হওয়া ভাইয়ের কথা বলছেন। আমার খুব মায়া হয়। তিনি বলেন:
'ক্যাপ্টেন রাজীব, আমি জানি আপনারা পাঁচজন সেনা কর্মকর্তা কেন কারাগারে। আমার সৌভাগ্য, আমি আপনাকে দেখতে আসতে পেরেছি। আপনাদের পাঁচজনের জন্য অন্তর থেকে দোয়া'।
আমি তখন দাঁড়িয়ে
অঝোর ধারায় কাঁদছি। আমার এই ভদ্রলোকের জন্য কষ্ট হচ্ছে। গেটের বাইরে থেকে
অবাক চোখে কারারক্ষী এবং আমজাদ তাকিয়ে আছে।
বড়
কর্তা যাবার সময়ে আমাকে গরাদের ভিতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন। আমি হাত ধরি।
তিনি আমাকে দোয়া করে দেন। বলেন, 'আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবেন। আল্লাহ
আপনাদের পাঁচজনের হেফাজত করবেন'।
এরপর তিনি আর কথা না বলে চলে যান। আমি স্যারের পরিচয়, তাঁর শহীদ সেনা অফিসার ভাইয়ের নাম জিজ্ঞেস করার সুযোগটুকু পাই না। আফসোস থেকে যায়। পরদিন থেকে আমার জন্য কারা ক্যান্টিনে খাবার কেনার অনুমতি পুনর্বহাল করা হয়।
২০১২
সালে গাজীপুর কারাগার পরিদর্শন করা বড় স্যার, এই গল্পটা আমি একদিন আমার প্রকাশিতব্য বইতেও লিখব। আপনি যদি কোন ঘটনাচক্রে আমার লেখা পড়েন, আমাকে
খুঁজে বের করে একটা সংবাদ দেবেন, প্লিজ। আমি আপনার সঙ্গে অবশ্যই সঙ্গে দেখা করব। আপনার সঙ্গে ক্ষণিকের দেখা এতো বেদনাময় যে এক
যুগ পরও, আপনার সেই বিষণ্ণ দৃষ্টি আমার আজও চোখে ভাসে।"
ব্যারিস্টার তাপস হত্যাচেস্টা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী একজন_দন্ডপ্রাপ্ত_আসামীর_জবানবন্দী। লেখক, রাজীব হোসেন
* শেখ হাসিনার কিছু লোকজনের কল্যাণে তছনছ হয়ে গিয়েছিল এই দেশের এমন-কিছু সেনা-কর্মকর্তাদের জবিন-যৌবন! আর যারা কেবল সেনা কর্মকর্তাই ছিলেন না, ছিলেন দুর্ধর্ষ প্যারা-কমান্ডো1 আস্ত একটা শহর উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন যারা, তাঁরা তাপসের মত পুঁচকে ছোকড়াকে হত্যা করতে বিফল হবেন এ কেবল হাস্যকরই না তাঁদের প্রশিক্ষকের আত্মহত্যা করার কথা!
যাই হোক, দেশবাসী এখন বিলক্ষণ জানে যে, পুরো ঘটনা ছিল সাজানো:
তাপসের উপর বোমা হামলার ঘটনায় মামলার তদন্তকারী অফিসার পরিদর্শক আরজু মিয়া বর্তমানে গাজীপুর জেলা সিআইডি দফতরে রয়েছেন। এ মামলার বিষয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, এ মতিজিল থানার এ মামলা তদন্তে গিয়ে গত ১৫ বছরের তদন্তে ঘটনার কোনো সত্যতা পাইনি। বাংলারবানী ভবনে স্থাপিত এসির বিস্ফোরনে বিকট শব্দে আওয়াজ হয়েছে। পাশাপাশি এসিটি বিধ্বস্ত হয়েছে। এমন তথ্যই তিনি পেয়েছে। এ ঘটনায় কারো কোনো জড়িত এবং সংশ্লিস্টতা পাওয়া যায়নি । যার কারণে এ মামলা ফাইনাল রির্পোট দাকিল করা হয়েছে আদালতে।
এবিষয়ে ব্রি, জে, অব. হাসান নাসির বলেছেন, প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করে রাখতে এ ঘটনা সাজানো হয়েছিল। এ ঘটনার মাষ্টার মাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে জিয়াউল আহসান, তারেক সিদ্দিকী, মোল্লা ফজলে আকবরসহ সাবেক ২০ সেনা কর্মকর্তা। সঙ্গে ছিলেন পুলিশ বিভাগের আলোচিত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম।
No comments:
Post a Comment